Left and Right Click

Wednesday, October 21, 2020

কি আনন্দের কথা উমে গো মা [Backstory of Maa Sarada- Briefly]

 

কি আনন্দের কথা উমে গো মা


এক সময় (সম্ভবত ১৮৯১ সালে) জয়রামবাটী গ্রামে একজন বৈরাগী (হরিদাস) এসে বেহালা বাজিয়ে গাইত দাশরথি রায়ের লেখা একটি আগমনী গান ---

"কি আনন্দের কথা উমে (গো মা)

(ওমা) লোকমুখে শুনি সত্য বল শিবানী,

অন্নপূর্ণা নাম তোর কি কাশীধামে?

অপর্ণে তোমায় যখন অর্পণ করি|

ভোলানাথ ছিলেন মুষ্টির ভিখারী|

এখন নাকি তার দ্বারে আছে দ্বারী,

দেখা পায় না তাঁর ইন্দ্র-চন্দ্র-যমে||

ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা আবার বলত দিগম্বরে,

গঞ্জনা সয়েছি কত ঘরে পরে|

এখন নাকি তিনি রাজা কাশীপুরে,

বিশ্বেশ্বরী তুই বিশ্বেশ্বরের বামে||


এই গান শুনে চোখের জলে ভাসতেন মা শ্যামাসুন্দরী দেবী- ও গান যেন তাঁর মেয়ে সারদামণিরও জীবনসঙ্গীত| চোখে তাঁর দেখা দিত আনন্দাশ্রু, গানটি বারবার শুনেও যেন তৃপ্তি হতো না| আবেগ-জড়িত কণ্ঠে উপস্থিত সবাইকে বলতেন- |হ্যাঁ গো, তখন সকলেই জামাইকে ক্ষেপা বলত, সারদার অদৃষ্টিকে ধিক্কার দিত| আমায় কত কথা শোনাত, মনের দুঃখে মোর যেতুম| আর আজ দেখ, কত বড়ো ঘরের ছেলেমেয়েরা দেবীজ্ঞানে সারদার পা পূজা করছে|"


সত্যিই তো, এ মেয়ের জন্য কম গঞ্জনা সৈতে হয়েছে তাঁকে? জয়রামবাটী গ্রামের সর্বত্র জানাজানি হয়ে গিয়েছিল সে কথা- দক্ষিণেশ্বরে মা কালীর মন্দিরে পূজারী হয়ে তাঁর জামাই নাকি পাগল হয়ে গিয়েছে- রাতদিন কেবলই মা! মা! করে কাঁদে| আর সেই সব কথা শুনে গাঁয়ের বৌ-ঝিরা তাই কানাকানি করত- "ওমা! শ্যামার মেয়ের ক্ষেপা জামাইয়ের সাথে বে হয়েছে|" আর তাই শুনে মেয়ের দুঃখে মায়ের বুক ভেঙে যেত| ভাবতেন, সবই অদৃষ্টের ফের! কিন্তু এই বুক ভাঙা দুঃখের মাঝেও শ্যামাসুন্দরী দেবী সময় সময় একটু সান্ত্বনা পেতেন যখন ওই গাঁয়েরই শুদ্ধস্বভাবা ভানুপিসি এসে খুব জোরের সঙ্গে তাঁকে বলতেন- :বউ ঠাকরুন, তোমার জামাই শিব, সাক্ষাৎ কৃষ্ণ- এখন যা বিশ্বাস করতে পারছ না, পরে পারবে বলে রাখছি|"


সারদামণিও জানতেন সে কথা| গিরিরাজ কন্যা উমার মতোই জানতেন তাঁর আত্মভোলা পতির স্বরূপ| জানতেন, গাঁয়ে যা রটেছে তা সত্যি নয়| তাঁর দেবতুল্য পতি পাগল হতেই পারেন না| মন তাঁর পড়ে থাকে দক্ষিণেশ্বরে- সেখানে গিয়ে পতিদেবতার সেবাযত্নের জন্য আকুল আগ্রহে দিন কাটাতে থাকেন| সে সুযোগও তাঁর এসে যায়| সেবার (চৈত্র মাস, ১২৭৮ সাল) কি এক পর্ব উপলক্ষে গ্রাম থেকে অনেক লোক কলকাতায় এসেছিলেন গঙ্গাস্নান করতে| সেই সময় সারদামণিও ভাবতেন- "সবাই এমন বলছে, আমি গিয়ে একবার দেখে আসি সেন আছেন|" বাবা তাঁর সেই মনের কথা বুঝতে পেরে তাঁকে নিয়ে হাঁটাপথে দক্ষিণেশ্বরের উদ্দেশে রওনা হলেন|


অনেক কষ্টে সারদামণি দক্ষিণেশ্বরে এসে পৌঁছলে তাঁর আপনভোলা পতি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন| দেখেশুনে সারদামণি বুঝলেন, গাঁয়ে যা রটেছে তা মিথ্যা- সব মিথ্যা| তাঁর পতি পাগল কোথা- তিনি যে দক্ষিণেশ্বরে ভক্তের রাজা| তাঁকে নিয়ে সেখানে আনন্দের হাট- পতি তাঁর আশ্রিতবৎসল- যে তাঁর শরণাগত তাঁকেই আশ্রয় দিচ্ছেন- দেখাচ্ছেন ভক্তি-মুক্তির পথ|


তাই জয়রামবাটীতে সেই বৈরাগীর আগমনী গান শুনে শ্রীমা সারদামণির জীবনের সেই অধ্যায়ের কথাই তখন সকলের মনে পড়ে যেত| সেই গান শুনে অনেকেই কাঁদতেন, যেমন কাঁদতেন শ্যামাসুন্দরী দেবী, সেইসঙ্গে যোগীন-মা, গোপাল-মা-- সারদামণির দুই সহচরী| এমনকি মহাকবি গিরিশচন্দ্রও যখন কলকাতা থেকে আসতেন, এই গান শুনে  তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারতেন না| তিনি শ্রীমাকে মনে করতেন-- "মাস জগদম্বা, জগজ্জননী"| আর বিশ্ববরেণ্য সন্নাসি স্বামী বিবেকানন্দের কথা তো আগেই বলা হয়েছে, মা সারদামণি তাঁর কাছে ছিলেন  সাক্ষাৎ 'জ্যান্ত দুর্গা'| 


সংকলন: বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গাপূজা (স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ) [উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা]

No comments:

Post a Comment